ইরফান মাহমুদ
বিরহ-আলস্যের বর্ষা বছর ঘুরে আবার এসেছে তার নিজস্ব ভঙ্গিতেই, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তার প্রিয় সৌন্দর্য কদম ফুলকে। গ্রীষ্মের প্রখরতা কমাতে যখন আম, কাঁঠালের ঘ্রাণে মুখর চারপাশ, ঠিক সে সময় আষাঢ়ে বাদলের দিনে আগমন ঘটেছে হৃদ্মোহিনী কদম ফুলের। তাই তো বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণের সঙ্গে সহসাই ভেসে আসে কদম ফুলের রেণুর মিষ্টি সুবাস। কদম আর বর্ষা একে অপরকে আলিঙ্গন করে রয়েছে বহুকাল ধরে। এ জন্য কদম ফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত।
রূপসী তরুর অন্যতম রূপবতী হলো কদম ফুল। গাছে গাছে সবুজ পাতার ডালে গোলাকার মাংসল পুষ্পাধার আর তার থেকে বের হওয়া সরু হলুদ পাপড়ির মুখে সাদা অংশ কদমকে সাজিয়ে তুলেছে ভিন্নভাবে। গোলাকার হলদে-সাদা মিশ্রিত ফুলটি দেখতে যেন ভোরের উষা। বর্ষার মেঘের সঙ্গে মিতালি বলেই কি না, এর আরেক নাম মেঘাগমপ্রিয়। আর নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই বলে ললনাপ্রিয়। এ ছাড়া সুরভি, প্রাবৃষ্য, বৃত্তপুষ্প, সিন্ধুপুষ্প, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী প্রভৃতি নামেও কদমের পরিচিতি আছে। এত এত ভিন্নতার ছোঁয়াতে কদম হয়ে উঠেছে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য।
একটি কদম্বগাছ হাজারও বলা, না বলা কথার সাক্ষী হয়ে আবহমান বাংলার মানুষের সঙ্গে গড়ে তুলেছে নিবিড় সখ্য। গোলাপ, জবা, বকুল, কৃষ্ণচূড়ার মতোই কদম ফুল মিশে আছে বাঙালির মননে, ভাব ভাবনার অন্তরিক্ষে হয়ে উঠেছে সাহিত্যের অন্যতম অনুষঙ্গ। কদম তলায় অচেনা পথিকের বাঁশির সুরে উতলা রমণীর আকুলতা নিয়ে লিখা পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের গান আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। রিমঝিম বৃষ্টিতে সিক্ত কোনো বিকেলে তিনটে কদম ফুল হাতে প্রেমিকের অপেক্ষার গল্পগুলো তো চিরায়ত। সেই গল্পে গোধূলীরাঙা আলোয় মন-মহুয়ায় আনন্দের সুর বাজায় অনুগামী কাদম্বিনী।
কদম ছাড়া বর্ষা যেন একেবারেই বেমানান। প্রাচীরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল কদম গাছগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় বর্ষা তার সবটুকু ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে মোটেই কার্পণ্য করে না। ফুলের পরাগ বেয়ে বৃষ্টির স্বচ্ছ জল চুইয়ে পড়ে আড়ষ্ট নেশার উদ্রেক তৈরি করে।
‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এ চরণ যেন দিন দিন আধুনিক জীবনে বর্ষা আবাহনের অনন্য ব্যঞ্জনায় পরিণত হয়েছে। হোক শহর কিংবা গ্রাম একগুচ্ছ কদম ফুল ছাড়া বর্ষার বার্তা জানাতেও এখন দ্বিধা আর সংকোচ।