ছাতক প্রতিনিধি:
মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের বে-সামরিক উপদেষ্টা, ছাতকের কৃতি সন্তান এমএনএ আব্দুল হকের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত ছাতকের প্রথম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ হাটি-হাটি পা-পা করে ৫০ বছর পূর্ণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর হাত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের ঊষা লগ্নে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যাপীঠ উচ্চ শিক্ষা প্রসারে চার যুগেরও বেশী সময় ধরে গৌরবের পথচলা রেখেছে অব্যাহত। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনায় বিচরণ করা অগনিত শিক্ষার্থী বর্তমানে রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রবাসে গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানটির বহু শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে আলোকবর্তিকা হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন মানব কল্যাণে। বহু চড়াই-উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ৫০ বছরের মাইল ফলক স্পর্শ করেছে। ৫০ বছরপূর্ত্তিকে স্মৃতির আয়নায় ধরে রাখতে কলেজে সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসব পালনের উদ্যোগ গ্রহন করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর শনিবার এক মাহেন্দ্রক্ষণে নবীণ-প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে সকলের প্রাণপ্রিয় বিদ্যাপীঠ গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ ক্যানভাস। এ দিনটিকে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজে সূবর্ণ জয়ন্তি উৎসব উদযাপনের সকল প্রস্তুতিও ইতিমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন এশুভ লগনের প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কলেজ কর্তৃপক্ষ। সূবর্ণ জয়ন্তি উপলক্ষে প্রস্তুত করা ম্যাগাজিন গাংচিলএ কলেজ অধ্যক্ষ সুজাত আলী রফিকের লেখা কলেজের ইতিহাস প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা প্রবেশ দ্বার গোবিন্দগঞ্জে প্রধান সড়কের পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয় গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ। তৎকালিন সময়ে বৃহত্তর ছাতক অঞ্চলে কোন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শিক্ষা ক্ষেত্রেও এ উপজেলা তুলনামুলক অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। এখানের অনগ্রসর শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এ অঞ্চলের বেশ কয়েকজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ গোবিন্দগঞ্জে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহন করেন। সবেমাত্র স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য্য উদয় হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টরের বে-সামরিক উপদেষ্টা, ছাতকের ভাতগাঁও গ্রামের কৃতি সন্তান এমএনএ আব্দুল হককে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর এ অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু তাদের লালিত স্বপ্ন তছনছ করে স্বধীনতার স্বাদ গ্রহনের আগেই না ফেরার দেশে চলে যান এমএনএ আব্দুল হক। ১৯৭১ সালে ১৯ ডিসেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান তিনি। এ মহান নেতার স্মৃতি ধরে রাখতেই ১৯৭২ সালের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ। এটিই ছিল ছাতকের প্রথম কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একই সালের ২৫ মার্চ কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক আবু মোহাম্মদ পরিদর্শনে এসে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিলে ১৯৭৩ সালের ৫ জুন গোবিন্দগঞ্জ আব্দুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ বোর্ডে অনুমোদন লাভ করে। প্রথমে গোবিন্দগঞ্জ নতুন বাজারে একটি টিন সেডের ঘরে কলেজের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহা সড়কের গোবিন্দগঞ্জ রেল ক্রসিং এলাকায় কলেজটিকে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন সিলেট এমসি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ। ১৯৭২ সালের ১ আগষ্ট একাদশ মানবিক ও বানিজ্য বিভাগের ক্লাস শুরুর মধ্য দিয়ে কলেজের পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের উদ্বোধন করে ছিলেন তৎকালীন সিলেটের জেলা প্রশাসক আব্দুল মালিক। প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে কলেজের সার্বিক উন্নয়নে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন ছাতকের আরো একজন কৃতি সন্তান, কলেজের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। ১৯৭৭ সালে ২৫ মে সিরাজুল ইসলাম অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৫-৭৬ শিক্ষা বর্ষে এ কলেজ বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার অনুমোতি লাভ করে। ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষা বর্ষে স্নাতক কোর্স চালু এবং ২০১৩-২০১৪ শিক্ষা বর্ষে রাষ্ট্র বিজ্ঞান, দর্শন ও হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর মধ্য দিয়ে এ কলেজ উচ্চ শিক্ষা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে বৃৃৃৃহত্তর ছাতক সহ আশ পাশের শিক্ষার্থীদের জন্য। বর্তমানে কলেজের কার্যক্রমের জন্য দ্বিতল বিশিষ্ট শ্রেনী ও প্রশাসনিক ভবন, দ্বিতল একাডেমিক ভবন, বিজ্ঞান গবেষনাগার, অনার্স ভবন, কম্পিউটার ল্যাব, ছাত্র মিলনায়তন রয়েছে। কলেজের প্রবেশ মুখে রয়েছে একটি দৃষ্টি নন্দন ফটক। সবুজের সমারোহে বেষ্টিত কলেজ আঙ্গিনায় বিরাজমান রয়েছে শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এক ঝাঁক দক্ষ শিক্ষকমন্ডলী দ্বারা চলছে এ কলেজে নিয়মিত পাঠদান। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল কলেজে প্রথম ভবন নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, তৎকালীন বিমান ও নৌ পরিবহন মন্ত্রী জেনারেল এমএজি ওসমানী। ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন দিঘলী গ্রামের বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থ। কলেজ প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিক থেকে বর্তমান পর্যন্ত যাদের অর্থ, ভুমি, শ্রম-ঘাম ও মেধা দিয়ে অবদানের রেখেছেন তাদের মধ্যে প্রিন্সিপাল সিরাজুল ইসলাম, জাউয়ার হাজী মোবারক আলী, গীতিকার গিয়াস উদ্দিন, ফজলুর রহমান, এড. আবুল হাসান, মাষ্টার আব্দুল লতিফ, আশিকুর রহমান আশিক, অধ্যাপক আব্দুন নূর তাহের, অধ্যাপক সৈয়দ মহাদ্দিস আহমদ। এ ছাড়া কলেজের উন্নয়নে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, সাবেক সংসদ সদস্য সামছু মিয়া চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত, সাবেক সংসদ সদস্য এড. আব্দুল মজিদ, সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন আহমদ মিলনের অবদান অনস্বীকার্য। কলেজের সীমানা প্রাচীর নির্মাণে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এমপি ও মুহিবুর রহমান মানিক এমপির অবদান রয়েছে।