ইসমাইলুল করিম নিজস্ব প্রতিবেদক :
বছর ঘুরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলে দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারীতে প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু যাঁদের তাজা রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলা ভাষা, তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলায় ৭টি ইউনিয়ন সহ বেশ গুটি কয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকলেও নেই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে।
বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার না থাকায় শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শহীদদের যথাযথ স্মরণ করতে পারেনা। তবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতে কলাগাছ বা কাঠ দিয়ে অস্থায়ী ভাবে শহীদ মিনার বানিয়ে দিবসটি পালন করলেও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে পালনই করা হয় না দিনটি। আবার কোথাও কোথাও শুধু মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্মরণ করলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সেটিও করা হয় না। কোনো কোনো শিক্ষার্থী দূর-দূরান্ত কিংবা উপজেলা শহরের শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও তা হয়ে ওঠে না অনেকেরই। ফলে ভাষার জন্য লড়াইয়ের পটভূমি ও ভাষা দিবসের মর্যাদা সম্পর্কে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতি বছর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছে ম্স্নান হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের।
জানা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর অদ্যাবদি উপজেলার ১২৭টির মধ্যে ১১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখনো শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা দেশ মাতৃকার টানে ভাষা দিবসে সকল বীর সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের যথাযথভাবে সুযোগ পাচ্ছে না। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবী তুলেছেন শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয়রা। এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার থাকলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা সহজে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পেত বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ৩টি কলেজ, সরকারি প্রাথমিক ৮৫টি ও ৪টি রেজি: প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৫ কিন্ডার গার্টেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ১৪টি। এছাড়া বেসরকারি বিদ্যালয় ও মাদরাসাসহ মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে অন্তত ১৯টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৩ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।
অপরদিকে আড়াই লাখের কাছাকাছি জনগণের বসবাস। তথ্য প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশের মতো এ উপজেলাও এখন প্রযুক্তিখাতে অনেকাংশে এগিয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে গত দুই দশকে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হয়েছে আগের চেয়ে অনেকগুণ। শুধুমাত্র পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপনের ক্ষেত্রে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি, সরকারী মাতামুহুরী কলেজে একটি, কোয়ান্টাম কসমো স্কুল এন্ড কলেজে একটি, চাম্বি স্কুল এন্ড কলেজে একটি, ডলুছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি, লামামুখ উচচ বিদ্যালয়ে একটি, গজালিয়া উচচ বিদ্যালয়, মেরাখোলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি, ৩নং রিপুজিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি, ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিনার রয়েছে। বাকি বিদ্যালয়গুলোতে এখনো নির্মাণ করা হয়নি শহীদ মিনার। ফলে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর ভাষা দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপজেলা সদরের বা ইউনিয়ন সদরে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসে দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না বানিয়ে শুধু আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল ও প্রভাত ফেরী করেই দিবসটি পালন করা হয়। স্থায়ীভাবে কোন শহীদ মিনার না থাকায় প্রতি বছর ভাষা দিবসে অস্থায়ীভাবে বাঁশ কাঠ দিয়ে নিজেরা শহীদ মিনার তৈরি করে বিভিন্ন বিদ্যালয়গুলোতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয় বলে জানান, রুপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছাচিংপ্রু মার্মা। তিনি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের জোর দাবী জানান।
সরেজমিন নুনারবিল মডেল, রাজবাড়ী, লামামুখ, ছাগল খাইয়া, লাইনঝিরি, কলিঙ্গাবিল পাড়া ও সাবেক বিলছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শহীদ মিনার নেই। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকায় তারা কখনো শহীদ মিনারে ফুল দেয়নি। ফুল দিতে গেলে অনেক দূরে যেতে হয়। তাই তারা যায় না।
প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শফি বলেন, সরকারীভাবে কোন বরাদ্দ না থাকায় শহীদ মিনার নির্মাণ করা যায়নি। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ মাহাবুবুর রহমান জানায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার না থাকার ব্যাপারটি জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্য। শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল করিম জনি বলেন, প্রজন্মের কাছে মাতৃভাষার অর্জন-ইতিহাস উপস্থাপন করার জন্য অবশ্যই শহীদ মিনার জরুরি। কিন্তু উপজেলায় ৮৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩টিতে শহীদ মিনার রয়েছে। বাকীগুলোতে শহীদ মিনার নেই। তবে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নিতে শিক্ষকদের মিটিং এ বলা হয়েছে।