কুষ্টিয়া প্রতিনিধি॥ ১৮অক্টোবর,২০২৪॥ “কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত- সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে” গানের এই মর্মবাণীর প্রতিপাদ্যে দেশের আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যতম পথিকৃৎ একুশে পদক প্রাপ্ত কুষ্টিয়ার গর্ব কবি ও গীতিকার আজিজুর রহমান (জন্ম: অক্টোবর-১৮, ১৯১৪, মৃত্যু: সেপ্টেম্বর-১২, ১৯৭৮) এর ১১০ তম জন্ম বার্ষিকীতে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদ্যাপিত হয়েছে। শুক্রবার, সন্ধায় সদর উপজেলার হাটশ হরিপুরে কবি সমাধি চত্বরে কবি আজিজুর রহমান জাতীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এ্যাড ফারুক আজম’র আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচনা সভা ও কবি রচিত কবিতা ও ছড়া পাঠ, গানসহ নৃত্য পরিবেশিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ০১নং হাটশ হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান এম মুশতাক হোসেন মাসুদ ও প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত তেকে কবি জীবনের সাহিত্য কর্ম নিয়ে আলোকপাত করে বক্তব্য রাখেন সাবেক বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ ইবি বর্তমানে রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ^বিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. শহিদুর রহমান। এছাড়া বিশেষ অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়া বারের সাবেক সভাপতি এ্যাড. জহুরুল ইসলাম, স্কুল শিক্ষক নজরুল ইসলাম, দিওল্ড কুষ্টিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আশরাফুল হক উজ্জল, পল্লী চিকিৎসক ডা. তহুরুল ইসলাম, ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন বাদশা, লেখক গবেষক আমজাদ হোসেন, ইউপি সদস্য সেলিম উদ্দিন, সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি বজলার রহমান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন কবি আজিজুর রহমান জাতীয় সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক হাসান আলী।
আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, আজিজুর রহমান কবি, গীতিকার, সম্পাদক, নাট্য সংগঠক। কর্ম বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তিনি তাঁর কালে অতলস্পর্শি, সব্যসাচী। জন্মেছিলেন সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে। তাঁর প্রকৃত জন্ম তারিখ-১৮ অক্টোবর,১৯১৪। দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘চরিতাভিধান’ গ্রন্থে তাঁর জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১৮ জানুয়ারি ,১৯১৭। এই ভুলটি অনেকের চোখেই হয়তো পড়ে যা দোষের কিছু নয়। প্রশ্ন হলো বাংলা একাডেমি জাতির মন ও মননের প্রতীক। জাতির ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক। বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি, বাংলা ভাষার লেখকদের বিশ^ দরবারে তুলে ধরাই এর প্রধান কাজ। সেই কারণে চরিতাভিধান গ্রন্থের সাথে জড়িত তথা বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এই দায় এড়াতে পারেন না।
দুর্ভাগ্যই ছিলো ফরাসি নাট্যকার জ্যাঁ জেঁনের ঈশ^র। একই ভাবে কবি আজিজুর রহমানের ক্ষেত্রে কথাটি চালিয়ে দেয়া যায়। কারণ তিনি ছিলেন জমিদারের ছেলে। অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে জমিদারদের জীবন জৌলুস এখনো এ অঞ্চলে কিংবদন্তি হয়ে আছে। সেই জীবন তাঁকে মোহাবিষ্ট করতে পারেনি। তাঁর জীবনের আলাদা আবেদন তাঁকে করেছে প্রান্তজনের সখা। সে জন্যেই তিনি গড়ে তুলেছেন নাট্যদল, করেছেন অভিনয়। আমরা দেখি আজিজুর রহমানের কবি পরিচয়কে ছাড়িয়ে গীতিকার পরিচয়টা বড় হয়ে ওঠে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোই তাঁর লেখা। কবি ও গীতিকার যে পরিচয়েই তাঁেক মূল্যায়ণ করা হোক না কেন, তাঁর লেখার মূল উপজীব্য প্রেম,প্রকৃতি ও দেশপ্রেম। তিনি ইসলামী গানও রচনা করেছেন। শিল্পী পরিচয় ছাড়িয়ে একজন মানুষ হিসেবেও ছিলেন শেকড় সন্ধানী। গণমানুষের সাথে তাঁর একটা সু-নিবিড় সম্পর্ক ছিলো।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘চরিতাভিধান” গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি প্রায় দুই হাজার গান রচনা করেছেন। কিন্তু নানা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।আমরা গানের সংখ্যার দিকটি বিবেচনা করবো না। বিবেচনা করবো তাঁর গানের বিষয় বৈচিত্র্য। গীতিকার হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ও সার্থকতার বিষয়টি। বাংলা চলচ্চিত্রের যখন স্বর্ণযুগ, তখন গীতিকার আজিজুর রহমানের গান স্বর্ণযুগের সোনার প্রতিমায় নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। মজার ব্যাপার যে গানগুলো তখনকার দিনে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো, সে গানের গীতিকার কে তা অনেকেরই অজানা। উল্লেখযোগ্য গানগুলি মধ্যে- “আমি রূপ নগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি”, “বুঝিনা মন যে দোলে বাঁশির সুরে”, “মন রে এই ভবের নাট্য শালায় মানুষ চেনা দায়”, “তারা ভরা রাতে তোমার কথা যে মনে পড়ে বেদনায়”, “অভিমান করোনা তুমি কিগো বোঝনা”।
এছাড়া পরাধীন মাতৃভূমির স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর গান মুক্তিযোদ্ধা ও এদেশের মানুষের মনে মুক্তির আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলেছে। তাঁর দেশগান ও সংগ্রামী চেতনার গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- “পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা আমার এদেশ ভাইরে”, “রক্তে রঙিন উজ্জ্বল দিন বহ্নি শিখায় জ¦লছে”, “দুর্বার ঝড় তুলে গতিবেগে উল্কার”, “ধানে ভরা গানে ভরা আমার এ দেশ ভাইরে”, “মুজিব এনেছে বাংলাদেশের নতুন সূর্যোদয়”।
বাংলাদেশে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পর ইসলামী সংগীত রচনায় কবি, গীতিকার আজিজুর রহমানেরও অসামান্য অবদান লক্ষ্য করা যায়। তাঁর লেখা ইসলামী গানগুলোর মধ্যে- “কারো মনে তুমি দিওনা আঘাত সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে”, “তোমার নামের তসবী খোদা লুকিয়ে যেনো রাখি”, তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম “ডাইনোসোরের রাজ্যে”, “জীবজন্তুর কথা” “ছুটির দিনে”, “এই দেশ এই মাটি”, “উপলক্ষের গান”সহ বেশকিছু সংখ্যক জনপ্রিয় গ্রন্থ রয়েছে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বিস্মৃতপ্রায় এই গুণী ব্যক্তিত্বের ১০৩ তম জন্ম বার্ষিকী পালনের প্রাক্কালে নিজেদের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতার ব্যর্থতা অনেক বেশি পীড়াদায়ক। তবুও মন্দের ভালো এই যে, আড়ম্বরে না হলেও মনের কোণে ভাবনার সীমানায় এ গুণী ব্যক্তিত্বকে যৎকিঞ্চিত হলেও হৃদয়ে ধারণ করে তা বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার এই প্রয়াস এটাইবা কম কি ?। রাখবো অনন্ত কাল। আমাদের মাধ্যমে উত্তর প্রজন্ম জানবে তাঁকে এবং তাঁর সৃষ্টি কর্মকে। আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য ও সংগীত পরিবেশন করে সপ্তসুর সংগীত একাডেমী ও নৃত্য রং। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এমএ কাইয়ুম।
ক্যাপশন ছবি দেয়া আছে।